ভেগান হোন, তবে ফুলপাতা না ছিঁড়ে!
– একটি পাতাঝরা সত্য, ডালপালা যুক্ত যুক্তির ভিতর দিয়ে
লেখক: এক হতভাগা আলুভাজা প্রেমিক
মানুষ কী খায়? একটু ভালোভাবে খেয়াল করুন—একটা সদ্যোজাত বাছুরের জন্য সৃষ্ট দুধ, একটা ডিম যার মধ্যে হয়ত কোনও “চিক্” পৃথিবীর আলো দেখত, বা মৌমাছিদের কষ্টে সংগৃহীত মধু, যা আসলে তাদের সন্তানের খাদ্য। এসবই আমরা হামাগুড়ি দিয়ে শুরু করে ডিনার টেবিল পর্যন্ত গলাধঃকরণ করি, আর কেউ কেউ কেঁদে ফেলে বলে, “ভগবান! এ আমরা কী করছি!”
এই দেখে হঠাৎ একদল সাধু, নব্যযুগের গেরুয়া বিহীন ভিক্ষুদের আবির্ভাব ঘটে—ভেগান। তাদের যুক্তি পরিষ্কার: “জানো, তুমি একেকটা ডিম খাও মানেই একেকটা বাচ্চা মারলে, দুধ খাও মানেই বাছুরের মুখের খাবার ছিনিয়ে নিলে!” এই শুনে মনে হয় ওরা বুঝি সোজা সন্ন্যাসী হতে চলেছে, গাছের ছায়ায় বসে বেদ পাঠ করবে আর আহার করবে কেবল “ভেজিটেবল স্যুপ”—মানে শাকসবজি, ডালপালা, ফুল, ফল—যা আবার ওদের মতে “কারও ক্ষতি না করেই আহরণযোগ্য”।
তবে একটু দাঁড়ান। একটুখানি জ্ঞানচক্ষু মেললে বোঝা যায়, গাছও বাঁচে, শ্বাস নেয়, ঘামায় (ট্রান্সপিরেশন), রেগে যায় (মিমোসা পাতার মত), আত্মরক্ষা করে (ক্যাকটাস বা বিষাক্ত ফলের মত), আর সন্তান ধারণ ও প্রেরণ করে (বীজ, ফল, ফুল)। এমনকি, গাছ কষ্টও পায়—এই কথাটা সায়েন্স বলেছে, কোন হুজুগে গাছতন্ত্র নয়।
গাছও অনুভব করে: তথ্যসূত্রে এক ঝলক
- The Secret Life of Plants (Peter Tompkins & Christopher Bird) নামক বইয়ে বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে গাছের বৈদ্যুতিক সংকেত, সাড়া দেওয়া, এমনকি ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
- ২০০৭ সালে University of Bonn এর এক গবেষণায় জানা যায়, গাছ কেটে ফেলার সময় বা পাতা ছিঁড়লে তারা chemical distress signals (Methyl jasmonate) ছাড়ে, যেন প্রতিবেশী গাছগুলো সতর্ক হয়।
- Monica Gagliano নামের এক উদ্ভিদ-গবেষকের কাজ প্রমাণ করে মিমোসা গাছ পুনঃপুনু বার বিরক্ত করলে প্রথমে পাতাগুলো গুটিয়ে ফেলে, পরে বুঝে নেয় বিপদ নেই বলে গুটোচ্ছে না—মানে স্মৃতি কাজ করছে।
তাহলে?
পাতা সূর্যের আলো, কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর মাটির জলের সাহায্যে গ্লুকোজ তৈরি করে, যেটা সারা গাছে পাঠিয়ে দেয়। এই খাবার ফুল, ফল, বীজ ইত্যাদি তৈরিতে যায়—অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখতে। ফুল গাছের যৌনাঙ্গ, আর ফল/বীজ হলো তার সন্তান। আমরা মানুষ, ঠিক এই সন্তানগুলোকেই কেটে কেটে খাই, চাটে, চিপি করে জুস বানাই।
একটা আম গাছ তার ফল বানিয়েছে একটা ভবিষ্যৎ আম গাছের আশায়। কিন্তু আপনি গিয়ে সজোরে ঝাঁকি দিয়ে আম পেড়ে মুখে পুরে বললেন, “ভেগান হি হ্যায়, কিসিকা জান নেহি লিয়া!”—এটা কি আদৌ ঠিক?
তাহলে, ভেগানরা কি সত্যিই কারও ক্ষতি না করেই বাঁচেন? উত্তরটা বেশ জটিল। আসুন একটু মজা করে দেখি—
ভেগানবাবুর একদিনের মেনু বিশ্লেষণ
সকালের জলখাবার: ওটস, সয়া দুধ, বাদাম
(পটাশিয়াম ও অ্যামাইনো অ্যাসিড সরবরাহ—অর্থাৎ গাছের বীজ ও উৎপাদনক্ষম প্রোটোপ্লাজম খেয়ে শুরু)
দুপুরের খাবার: চিয়া সিড সালাদ, অ্যাভোকাডো, লেটুস
(সবাই গাছের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা তাদের অঙ্গ, যারা বংশ চালাবে বা নিজের প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে—আপনি চিবিয়ে চিবিয়ে শেষ করে দিলেন)
রাতের খাবার:\u003c/b> লেন্টিল স্যুপ, ব্রোকলি, কোয়িনোয়া
(ডাল মানে গাছের সন্তান। ব্রোকলি তো আসলে গাছের অজাত ফুল, মানে ফুল হওয়ার আগেই আপনি সাবাড় করে দিলেন।)
এই তো সাধু! খুব ভালো কর্ম করলেন, এবার ঘুমান।
মধু খাওয়া পাপ, কিন্তু মধুচক্র চালানো নয়?
ভেগানরা বলেন, “মধু খেয়ো না, ওটা মৌমাছিদের বাচ্চার জন্য।”
সত্যিই মধু হলো মৌমাছিরা ফুল থেকে সংগ্রহ করা নিঃসরণ, যা তারা তাদের হাইভে জমা করে ভবিষ্যতের জন্য, বিশেষত তাদের লার্ভার খাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মৌমাছি কি কেবল আমাদের জন্য কাজ করছে?
না! তাদের জীবনধারা এমনই যে তারা সেটা করবেই। মানুষ সেই খাদ্য চুরি করছে। ঠিক যেমন আমরা গরুর দুধের বাণিজ্যিক উৎপাদনে বাছুরের খাবার নিয়ে নিই। তবে গরুর দুধের উৎপাদন পদ্ধতি যেখানে অমানবিক, মৌমাছির ক্ষেত্রে সঠিক চর্চা থাকলে সেই মাত্রাটা তুলনামূলক কম হতে পারে।
তা সত্ত্বেও, এই বিতর্ক চলতে থাকে। কিন্তু মূল কথাটা হলো—সব খাদ্যই কোনও না কোনও প্রাণ বা প্রাণসংক্রান্ত উপাদানের উপর নির্ভরশীল।
শুধু পশুপ্রেম, গাছপ্রেম নয় কেন?
ভেগানিজম মূলত পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে চালু হয়, তবে তারা গাছের প্রতি কোনও সহানুভূতি দেখায় না। গরুর চোখে চোখ রেখে আপনি বলবেন, “আমি তোমায় মারব না”—এটা ভালো। কিন্তু একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে তাকে বাঁচার রসদ না দিয়ে বলবেন, “তুমি তো প্রাণী নও”—এটা আদৌ সুবিচার?
“Just because plants don’t scream, doesn’t mean they don’t suffer.”
— Michael Pollan, The Botany of Desire
তাহলে কি খাব?
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। তবে একটা কথা স্পষ্ট—আপনি যাই খান না কেন, জীববৈচিত্র্যের কোনও না কোনও অংশের উপর তার প্রভাব পড়বেই।
ভেগানিজমের মতো জীবনচর্চা পরিবেশবান্ধব ও সঠিক পশুপালনের বিকল্প ভাবনার দরজা খুলতে পারে, কিন্তু এটা যেন আত্মগর্বের উপকরণ না হয়ে যায়। কেউ যেন খাদ্যাভ্যাস দিয়ে নিজের “নৈতিকতা”র সার্টিফিকেট বিলি না করেন।
শেষ কথা: সাধু সেজে সাধু হওয়া যায় না!
ভেগানিজম যেমন খাদ্যের ক্ষেত্রে চেতনা আনে, তেমনি তারও সীমাবদ্ধতা আছে। খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে থাকাটাও একধরনের অস্তিত্ববাদী লড়াই। গাছ খাও, পশু খাও, মাছ খাও, ডাল খাও—সবখানেই কোনও না কোনও বস্তুর বা প্রাণের শেষ ঘটে।
তাই “আমি একেবারে পাপমুক্ত”—এই দাবির মধ্যেই যে আত্মপ্রবঞ্চনার গন্ধ, সেটাই এই লেখার আসল মজা।
তোমার ডাল মেরে ফেলেছে গাছের সন্তানকে,
আমার ডিম মেরেছে বাচ্চার স্বপ্নকে।
তবে মজা একটাই—দুজনেই খেয়েছি আর বেঁচে আছি।
আর ব্যঙ্গ করছি পরস্পরকে।
তথ্যসূত্র
- Tompkins & Bird: The Secret Life of Plants
- Monica Gagliano: Thus Spoke the Plant
- University of Bonn Plant Neurobiology Research
- Michael Pollan: The Botany of Desire
- Journal of Experimental Botany (Oxford Academic)
- BBC Earth Documentary: “Do Plants Think?”